এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ (উত্তরণ কলাম)

লেখকঃ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(০৯ নভেম্বর ২০২৩, উত্তরণ )

বাংলাদেশ করোনা মহামারি-পূর্ব প্রায় ১০ বছর ধরে (২০০৯-২০১৯) অর্থনৈতিক বিকাশ সাধনে ধারাবাহিকভাবে অভূতপূর্ব পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। ২০২০ সাল থেকে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত প্রশংসনীয়ভাবে মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার পথে বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যেসব টানাপোড়েন রয়েছে, এগুলো কাটিয়ে উঠে আবার দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে- এই আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই। নিম্নে এই বক্তব্যের অনুকূলে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদে (জিডিপিতে) প্রবৃদ্ধি ২০১০-১১ সালে ছিল ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এরপর তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৮-১৯ সালে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার, দারিদ্র্যের হার, নারীর ক্ষমতায়নসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় ঐ সময়ে। ফলে একটি শক্ত ভীত তৈরি হয় দেশে, যাতে তৎপরবর্তী সময়ে সেই অর্জন সুসংহত করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত করা যায়। অবশ্য আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বাড়ছিল; কিন্তু অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে এই সমস্যা চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কার্যকর বাস্তবায়ন করার নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, বিশেষ করে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে। স্মর্তব্য, টেকসই উন্নয়ন সেই উন্নয়ন, যে উন্নয়ন সর্বজনগ্রাহ্য (অর্থাৎ সকলেই ন্যায্যভাবে অন্তর্ভুক্ত) এবং পরিবেশসম্মত (অর্থাৎ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষিত হয় এমন) অর্থনৈতিক অগ্রগতি। তবে ঐ পথে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে হঠাৎ করে দেশে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় ২০২০-এর মার্চ মাসে দেশে করোনা মহামারি আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে। সমগ্র পৃথিবীই চীনের ইউহানে শুরু হওয়া এই মহামারির কবলে পড়ে।
সংক্রমণ প্রতিহত করতে মানুষের চলাচল ও মেলামেশায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করা জরুরি হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে প্রত্যেক করোনা আক্রান্ত দেশেই ব্যাপকভাবে নানা মেয়াদে লকডাউন জারি করা হয়। সচেতন মানুষ নিজে নিজেই এই অনুশাসন পালন করে, লকডাউনের নির্দেশনা না থাকলেও। কাজেই অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্রই ব্যাপকভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। উৎপাদন ব্যাহত হয় পৃথিবীর সর্বত্রই। সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না, থাকার কথাও ছিল না। তবে বিভিন্ন মূল্যায়নে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে করোনা মহামারি মোকাবিলা করে একদিকে জীবন রক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় এবং অপরদিকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়া দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের অসংখ্য মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মোটামুটি পর্যায়ের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টিকারী সাফল্য অর্জন করে।
করোনাকালেও বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অর্জন প্রশংসনীয় ছিল। ২০১৯-২০ সালে পৃথিবীর মাত্র ১৬টি দেশ দেশজ উৎপাদে (জিডিপিতে) ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। এগুলোর মধ্যে ৫টি দেশ তুলনামূলকভাবে এগিয়েছিল। বাংলাদেশ সেই ৫টি দেশের মধ্যে অন্যতম। করোনাকালে প্রথমদিকে কিছুটা স্লথ হলেও, রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে শিগগিরই অর্জন বাড়তে থাকে, বিশেষ করে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে। একইসঙ্গে আমদানির ক্ষেত্রে কিছু সাশ্রয় হওয়ায়, বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতি বৃদ্ধি পায়। ২০১৯-২০ সালে গড়ে তা ছিল ৩৬ দশমিক ০৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২০-২১-এ ৪৬ দশমিক ৩৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০ আগস্ট ২০২১-এ স্থিতি ছিল এ যাবৎ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনাকালে পদ্মা সেতু ও ঢাকা মেট্রোরেলের একটি অংশের কাজ শেষ এবং উদ্বোধন করা হয়। কৃষি খাতে করোনাকালেও অব্যাহত সাফল্যের ফলে বাংলাদেশ খাদ্য সংকটে পড়েনি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশও বিরাজমান বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য হারে এগিয়ে চলেছে।
মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে ছিল করোনাকালে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত এই তিন বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অবশ্যই করোনাকালে বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, অনেকের পুনর্জাগরণও সহজ ছিল না। এ-রকমটি শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত এবং উন্নয়নশীল সব দেশেই ঘটেছে। তবে বাংলাদেশ সার্বিক দুঃসময় মোকাবিলা করা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা সীমিত সংখ্যক দেশের অন্যতম। উল্লেখ্য, বিভিন্ন খাতে উৎপাদন, বিপণন, পুনরুদ্ধার ও পুনর্জাগরণের সমর্থন জোগাতে সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সমর্থন দিয়েছে করোনাকালব্যাপী। দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয় যথেষ্ট দাপটের সঙ্গে। দেশজ উৎপাদে (জিডিপিতে) প্রবৃদ্ধির কথাই যদি ধরা যায়, তা ছিল ২০২০-২১ সালে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং ২০২১-২২ সালে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। কিন্তু ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা বিশ্বব্যবস্থা ও বিশ্ব-অর্থনীতির ওপর ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব ফেলে।
এই যুদ্ধের ফলে বিভিন্ন পণ্যের আন্তর্জাতিক সরবরাহ প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে, বিশেষ করে জ্বালানি তেল, খাদ্য-শস্য এবং সারের ক্ষেত্রে। এই পণ্যগুলোর আন্তর্জাতিক সরবরাহে যুদ্ধলিপ্ত দেশ দুটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। জাহাজ চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হয়, ব্যয়ও বাড়ে। যেহেতু জ্বালানি তেল উৎপাদন, বিপণন এবং স্থলপথ, নৌপথ এবং সমুদ্রপথে চলাচল ও পরিবহণে একটি মৌলিক উপাদান, তাই জ্বালানি তেলের সরবরাহে ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধি দেশে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপর্যুক্ত সবক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করে।
লক্ষণীয়, যুদ্ধটি শুরু হওয়ার ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে উল্লিখিত এবং সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর মূল্য যুদ্ধ-পূর্ব পর্যায়ে চলে আসে। তবে ইতোমধ্যে দেশে দেশে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়ে যায়, তা থেকে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সবক্ষেত্রে আশানুরূপভাবে এগিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা, ক্ষেত্রবিশেষে স্থবিরতা বিরাজমান রয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি ঘটে; পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো দেশে উন্নতি হয়েছে, আবার কোনো কোনো দেশে উঁচুমাত্রায় বিরাজমান রয়েছে। বাংলাদেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বর্তমানে গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশের মতো এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া, সামষ্টিক অর্থনীতিতে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। অবশ্যই অর্থনীতি এক ধারাবাহিকতায় সব সময় চলে না। একটি সময় ধরে (হতে পারে এক যুগ) বিকশিত হয় ধারাবাহিকভাবে, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে যাত্রাপথে ধীরগতি, দোদুল্যমানতা, মন্দাভাব, এমনকি সংকোচন ঘটতে পারে। কারণগুলোর মধ্যে থাকতে পারে আন্তর্জাতিক কোনো সংকট, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রায় ১০ বছরব্যাপী দ্রুতগতিতে বিকশিত হয় এবং ২০১৯ নাগাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছে, যেখান থেকে অর্জনগুলো সুসংহত করে অগ্রগতি তরান্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তখনই আসে বড় ধাক্কা, করোনা মহামারি এবং পরে ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে। আর দ্রুত খারাপ হতে থাকা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান অভিঘাত রয়েছেই।
বর্তমানে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ছাড়াও যেসব সমস্যা বিরাজমান, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা, টাকার অবমূল্যায়ন এবং বিনিময় হারে অব্যাহত অস্থিরতা, ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনায় নানা ঘাটতি, উঁচুমাত্রার খেলাফি ঋণ, বিদেশে ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার, নিচুমাত্রার কর- দেশজ উৎপাদ (জিডিপি) অনুপাত।
ইতোমধ্যে একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথম কিস্তি (৪৪৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন) ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ আইএমএফ ছাড় করেছে। বাংলাদেশ সরকার কিছু শর্তপূরণ সাপেক্ষে এই ঋণ নিয়েছে, যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এই পরিমাণ অর্থ তেমন উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো বিদ্যমান বলে উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, আইএমএফ প্রদত্ত শর্তগুলো সেসব সমস্যা-সংক্রান্ত।
আইএমএফ-এর ঋণ নেওয়ার আগেই সরকার এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। কোনো কোনো পদক্ষেপ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ক্রটিপূর্ণ (যেমন- উচ্চমূল্যস্ফীতির সময় বিশাল অংকের নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া এবং ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া) এবং কোনো কোনো গৃহীত পদক্ষেপ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় (যেমন- সরকারি অর্থে বিদেশগমন নিরুৎসাহিত করা হলেও বাস্তবে তা তেমন কার্যকর হয়নি) সুফল তেমন পাওয়া যাচ্ছিল না। আইএমএফ-এর সঙ্গে বিশদ আলোচনা এবং নিজেদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে বর্তমানে আর্থিক ও রাজস্ব নীতিতে সংস্কারমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন, নজরদারি জোরদারকরণ এবং ব্যবস্থাপনিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবতার আলোকে সমস্যাগুলোর যৌক্তিকভাবে উপশমের প্রচেষ্টা চলছে, যা আগামী দিনে আরও জোরদার করা হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, অতি সম্প্রতি আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার সময় হওয়ায় শর্তগুলো পূরণে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়েছে কি না তা মূল্যায়ন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও মূল্যায়ন দল বলেছে যে, এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আগামীতে নিতে যাচ্ছে, তা প্রশংসনীয়। তবে অঙ্গীকার এবং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, অব্যাহত রাখতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইএমএফ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে।
করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত থেকে আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধার ও পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়া সাবলীল করার আর্থ-রাজনৈতিক অনুশাসন রয়েছে। কাজেই সংশ্লিষ্ট সকল নীতি-নির্ধারণকারী ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে বাস্তবতার আলোকে যথাযথ তথ্য ও বিশ্লেষণভিত্তিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। অবশ্যই মূল্যস্ফীতির হার আগামী বছরের মধ্যে ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, টাকার বিনিময় হার চাহিদা ও সরবরাহের বিচারে যৌক্তিকীকরণ, কর-দেশজ উৎপাদ (জিডিপি) অনুপাত বছর দুয়েকের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে এখন থেকে ধারাবাহিক যৌক্তিক উন্নতিসাধন এবং খেলাপি ঋণ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। টাকার বিনিময় হার সহসাই পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে আমি নই। সেক্ষেত্রে টাকার বিস্তর অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে। ফলে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে এবং মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হবে।
যেহেতু বাংলাদেশে মাসিক গড় মোট আমদানি ব্যয় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো, ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর সক্ষমতা অব্যাহতভাবে রাখার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতি যাতে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে না আসে, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে।
আরও একটি বিষয়ে অধিকতর জোর দিতে হবে আর তা হচ্ছে, বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন পর্যায়ের দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। যেমন- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালিত SIEP প্রকল্প Skills for Employment Investment Project), যার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি কিছু পদক্ষেপও রয়েছে এক্ষেত্রে, তবে প্রয়োজন আরও অনেক ব্যাপক। ফলে এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের আরও অনেক করণীয় রয়েছে। দক্ষতা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতেও জোর দিতে হবে। উল্লেখ, যেসব সমস্যা সম্বন্ধে উপরে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
সবশেষে বলতে চাই, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেসব বাস্তবানুগ সংস্কার সাধন করা হচ্ছে এবং আগামীতে করা হবে, সেগুলোর কার্যকারিতা আশানুরূপ হতে হলে দেশে বিরাজমান দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি এবং যেসব চক্র (তথাকথিত সিন্ডিকেট) নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে (যথা- আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে কারসাজি, বিদেশে অর্থ পাচার, খেলাপি ব্যাংক ঋণ, কর না দেওয়ার সংস্কৃতি, বাজারে কৃত্রিমভাবে ঘাটতি সৃষ্টি করে মুনাফা লুট করা ইত্যাদি) বিরাজমান রয়েছে, সেগুলোকে হটাতে হবে। এ-কাজে যত অগ্রগতি হবে, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান তত সহজ হয়ে যাবে। তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ যথাযথভাবে কাজ করতে পারবে, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে। ফলে লক্ষ্যভুক্ত সফলতা অর্জন সহজতর হবে এবং দেশের অগ্রগতি দ্রুত সেই ধারায় ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হবে, যে ধারা ২০০৯-২০১৯ সময়ে রচিত হয়েছিল। অব্যাহত জোরদার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেই ধারাকে আরও সুসংহত এবং গতিশীল করতে হবে। এর জন্য অব্যাহত স্থিতিশীল সার্বিক আবহ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। আর এমন আবহের বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা রাখবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই পথেই দেশ ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ২০৩১ সাল নাগাদ মধ্য আয়ের দেশ হওয়া এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত, স্মার্ট, কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের দিকে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে চলবে- এই আশাবাদ যৌক্তিকভাবে উচ্চারণ করা যায়।

তথ্যসূত্র
* অর্থবিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩’, ঢাকা, জুন ২০২৩
* কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিক্রমা : কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি’, কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ (সম্পাদক), ‘দেশ এগিয়ে চলেছে’, চতুরঙ্গ প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২৩

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত

Source: https://uttarannews.com/এগিয়ে-চলছে-বাংলাদেশ

About the author