স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভাবনা (ইত্তেফাক কলাম)

(দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬শে মার্চ, ২০২১) আজ ২৬শে  ২০২১; বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। অভিনন্দন ও উত্সবের আমেজে সবাই নিশ্চয়ই মাতোয়ারা। প্রথমেই গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এই স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা-পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তার মাগফিরাত কামনা করি। তারই ঘোষণায় ১৯৭১-এর ২৬শে মার্চ দেশ স্বাধীন হয় এবং তারই নির্দেশনায় দেশকে পাকিস্তানি দখলদারিত্ব-মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তী ২৬৫ দিন মুক্তিযুদ্ধশেষে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সব শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও অধিকার-স্বাধিকার-স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন সময়ে অন্য যারা শহিদ হয়েছেন তাদের সবাইকে। গাজী মুক্তিযোদ্ধাসহ সব নারী-পুরুষ যারা নানা অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করেছেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে ও সময়ে তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।

যে সব মুক্তিযোদ্ধা এখনো জীবিত আছেন, তাদের জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি মাসিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ২০ হাজারে উন্নীত করেছেন। তাদের মধ্যে যারা নানাভাবে অসুবিধাগ্রস্ত অথবা অসুস্থ তাদের পাশে দাঁড়ানো সমর্থ সবারই কর্তব্য। আমি বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামগঞ্জে ঘুরছি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের কাজ-কর্ম দেখতে ও সাধারণ মানুষের বাস্তবতা বুঝতে এবং সেই অনুসারে কর্মসূচি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে। সব সময় স্থানীয় জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়াতে সাধারণত সমর্থদের মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করেছি। স্বাধীন দেশে বাঙালির শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে যারা জীবন বাজি রেখে লড়েছেন, তাদের দুঃখ লাঘবে যারা সচেষ্ট হন না, তারা নিশ্চয়ই বিবেকহীনতায় আক্রান্ত। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে ২০২টা ইউনিয়নে সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় ঐ সব ইউনিয়নে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের পাশে প্রয়োজনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে দেশের জন্য যুদ্ধে কোনো ব্যক্তি নিহত হলে তার পরিবারকে ‘স্বর্ণ তারকা পরিবার’ (Gold Star Family) হিসেবে চিহ্নিত করে সম্মান জানানো হয় এবং উপযুক্ত আর্থিক ভাতাসহ সম্মানজনক অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারদের অবস্থান যথাযথভাবে সুসংহত ও সম্মানজনক কেমন করে করা যেতে পারে, তা বিবেচনার দাবি রাখে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অনেক ধান্দাবাজ লোক মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। বর্তমান সরকার যাচাইবাছাই করে একটি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করার চেষ্টা করছে, যা প্রকাশ করার কথা এরই মধ্যে।

আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী প্রত্যক্ষ করছি। শুধু কি তা-ই। একই সঙ্গে এই স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা-পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মুজিব-বর্ষ পালন এই সময়েই চলছে। জাতি এক অত্যন্ত গৌরব-মণ্ডিত সময় পার করছে। যদিও কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের আনন্দ-উত্সবকে অনেকখানি অবদমিত করেছে এবং সব কর্মসূচি যথেষ্ট সীমিত আকারে এবং সতর্কতার সঙ্গে পালন করতে হচ্ছে। তবুও আগ্রহ ও উত্সাহের কমতি নাই। বাঙালি জাতিকে কেউ বা কোনো কিছু দাবায়ে রাখতে পারে না।

এক সময় বাঙালির সামর্থ্যের বিষয় সঠিকভাবে অনুধাবন না করতে পেরে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল। আর আজ অবাক হয়ে আমাদের অসামান্য অগ্রগতিকে নন্দিত করা হচ্ছে। যেমন তাচ্ছিল্য করা চরম অবিবেচনা প্রসূত উক্তি ছিল, তেমন অবাক হওয়াও অযৌক্তিক। বাঙালি জাতি এগিয়ে যাচ্ছে অনমনীয় আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে। অবাক চোখে দেখা মানে এই দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশের এরকম উচ্চতায় যাওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু কেমন করে যেন বা হঠাত্ করে তা ঘটে গেল। কাজেই অবাক না হয়ে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য আর্থসামাজিক অর্জন এবং দ্রুত এগিয়ে চলাকে বাঙালির সহজাত তেজোদীপ্ত এগিয়ে চলা হিসাবে দেখা উচিত।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। লক্ষ্য ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। করেনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোভিড-১৯ থেকে মানুষের জীবন রক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত অসংখ্য জনের জীবিকা রক্ষা এবং অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে বাংলাদশ যে পারঙ্গমতা দেখিয়েছে তার ফলে দেশ দ্রুতই কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী উন্নয়ন ধারায় ফিরে যাবে এমন প্রাক্কলন করা যায়। বাংলদেশের এই ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা (রেজিলিয়েন্স) দেশ বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সবার ন্যায্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন তাতে একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না, সবাইকে ন্যায্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ই এই দিকনির্দেশনা রয়েছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয়ী মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণায়। বিজয় পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি সবার সব রকম বঞ্চনা থেকে মুক্তি এবং দেশের অগ্রগতিতে ন্যায্য অন্তর্ভুক্তির কথা বিশেষ জোর দিয়ে বলেন। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারেও এদেশে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার অঙ্গীকার করা আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে: যথা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিকেন্দ্রায়ন নিশ্চিত করা, সুশাসনে ঘাটতি দূর করা, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সার্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করা, প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় প্রাপ্তি অবারিত করা, দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বৈষম্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলার আরব্ধ কাজ এগিয়ে নেওয়া এবং সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গিবাদ সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য-সহনশীলতার ভিত্তিতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা। প্রতিবন্ধকতাগুলো এভাবে চিহ্নিত করা কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকারের আলোকে দূরদর্শী বিবেচনা বলে প্রতীয়মান হয়। আমার আশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী দিনে দেশের দৃপ্ত পদে এগিয়ে চলার পথপরিক্রমা রচনায় উল্লিখিত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করে এযাবত্ অর্জন সুসংহত, অগ্রগতি তরান্বিত এবং এই প্রক্রিয়ায় আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ সব অঙ্গনে সবার ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে এবং ফলে দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যমুক্ত দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্থাত্ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই আমার প্রত্যাশা।

লেখক: কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

Source link: www.ittefaq.com.bd/print-edition/features/independence-day/232022/স্বাধীনতার–সুবর্ণজয়ন্তীতে–ভাবনা

About the author