আটাশতম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন: বাস্তবতা সম্বন্ধে কিছু কথা

লেখকঃ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(২৪ নভেম্বর ২০২৩, দৈনিক বাংলা)

২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) আগামী (অর্থাৎ ২০২৩-এর) ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। এবার দুবাইতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবারের মতো সব দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যে নানা দিক আছে, সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও দেনদরবার করবেন। কিছু বিষয় অধিকতর পরিষ্কার করা হবে এবং কিছু ক্ষেত্রে মতৈক্যও হয়তো হবে। আগে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন কতটুকু হলো বা নাহলো তাও মূল্যায়ন করা হবে। এই সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিভিন্ন আঙ্গিকে (গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, অভিযোজন, অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি) বর্তমান বাস্তবতা অর্থাৎ এ পর্যন্ত কোন ক্ষেত্রে কী করা হয়েছে ও কতটা অগ্রগতি হয়েছে বা হয়নি এবং বিভিন্ন দেশ ও দেশগোষ্ঠী তাদের অঙ্গীকারগুলো কতটা বাস্তবায়ন করেছে আর কাজগুলো তারা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছে, এসবের একটি মূল্যায়ন বিবেচনা করা। মূল্যায়িত বাস্তবতায় আগামী সময়ে কী করতে হবে, তা আলোচনা করা হবে। কোন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে; আবার কোন কোন বিষয়ে হবে না, পরবর্তী কপ-এ আলোচনার জন্য বা অন্য কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে পরবর্তী কোনো কপ-এ বিবেচনার জন্য রেখে দেয়া হবে। সিদ্ধান্ত হলেও অনেক সময় বাস্তবায়িত হয় না বা খণ্ডিতভাবে হয়, যেমন- ২০০৯ সাল থেকে ঐকমত্য ছিল যে, উন্নত বিশ্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে বছরে এখন মাত্র ২০-২২ বিলিয়ন ডলারের মতো দিচ্ছে যদিও দাবি করা হচ্ছে যে, তারা বছরে ৮০ বিলিয়ন বা ততধিক ডলার দিচ্ছেন। এভাবেই চলে আসছে এবং আগামী সময়ে হয়তো এভাবেই চলতে থাকবে। আর জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে।

একদিকে আমরা আলোচনা করেই যাচ্ছি, প্রতিবেদনও বের হচ্ছে- শুধু প্রতিবছর কপ-এই নয় আলোচনা ও দেনদরবার হচ্ছে জাতিসংঘে, আঞ্চলিকভাবে, বিভিন্ন দেশে এবং দেশে দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য রিপোর্টও বের হচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন জুলাই ২০২৩-এ যতদিন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। ইউরোপে ২০২৩ গ্রীষ্মকাল একইভাবে উষ্ণতম ছিল।

উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। অর্থাৎ ক্রমবর্ধমান হারে বরফ গলছে, সমুদ্রপীঠ স্ফীত হচ্ছে এবং পৃথিবীর সর্বত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। প্রকৃতির দুর্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, আনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, দাবানল, নদীভাঙন, জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টি। প্রত্যকটির প্রকোপ বেড়েই চলেছে, সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি সাধন উভয় দিক থেকে পৃথিবীর সর্বত্র।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি যে, ঘূর্ণিঝড় এ বছরেই তিনটি হয়ে গেল, আগে কয়েক বছর পরপর ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতো। এ বছরের ঘূর্ণিঝড়গুলো তেমন শক্তিশালী না হলেও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একটি ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাত থেকে উত্তরণের আগেই আরেকটা হয়ে যাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস ঘন ঘন ঘটছে এবং ফলে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপকভাবে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটছে। নদীভাঙন দ্রুত বাড়ছে। উদ্বাস্তু হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।

জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, যার বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত হওয়ার পরিমাণ বর্তমানে দুই মিলিয়ন বছরে সর্বোচ্চ এবং নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। কাজেই অবস্থা যে আরও খারাপের দিকে যাবে তা অবধারিত। ২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় যে, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রথম শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা হবে। এ লক্ষ্য এখন অবাস্তব আশাবাদ। ইতোমধ্যে পৃথিবী ১ দশমিক ১ ডিগ্রি উষ্ণতর হয়ে গেছে, কোনো কোনো তথ্যে দেখা যায় উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে পৌঁছে গেছে অতিসম্প্রতি। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর সব দেশ যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে বলে প্রস্তাব করেছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলেও পৃথিবী এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি বা ততধিক উষ্ণতর হবে।

বিজ্ঞানভিত্তিক দিকনির্দেশনা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমানো না যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ হয়ে পড়বে। আর এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত খারাপ হতে থাকলে, কতদিন বাংলাদেশের মতো একটি দেশ অভিযোজন করে যেতে পারবে? অবস্থা খারাপ হতে থাকবে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে এবং মানুষের দুর্ভোগ বাড়তে থাকবে। কাজেই আসন্ন কপ-এ সর্বাধিক গুরুত্বপ্রাপ্ত দাবি হবে বিজ্ঞানভিত্তিক তাগিদ অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা, যাতে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে বর্তমান উন্নত বিশ্বকে, অবশ্য অন্য সব দেশকেও দায় ও সক্ষমতা অনুসারে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে খুবই সোচ্চার হতে হবে।

অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিযোজন এবং অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন এবং অন্যান্য উপকরণ (প্রযুক্তি, সক্ষমতা)। প্রকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে তাই অভিযোজনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত ও গভীর হচ্ছে। ফলে অভিযোজনের জন্য অর্থের প্রয়োজন বাড়ছে। অর্থের ক্ষেত্রে শুধু পরিমাণ বাড়ানো নয়, ছাড়করণ প্রক্রিয়াও সহজতর করতে হবে। সবুজ অর্থায়ন তহবিল (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) একটি প্রকল্প মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত ৪-৫ বছর পর্যন্ত সময় লাগায়। ইতোমধ্যে বাস্তবতা অনেক পরিবর্তিত হয়ে যায়- সাধারণত অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রকল্প গৃহীত হলেও এর উপযুক্ততা সীমাবদ্ধতায় পড়তে পারে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে সোচ্চার হতে হবে।

এই জলবায়ু বিশ্ব সম্মেলনের উৎপত্তি ১৯৯২ সালে। ওই সালে ব্রাজিলের রিয়োতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ আয়োজিত ধরিত্রী সম্মেলনে ইউএনএফসিসিসি (ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)) গৃহীত হয়। এই কনভেনশনের আওতায় জলবায়ু বিশ্ব সম্মেলন বা কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে।

এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে (করোনার কারণে ২০০০ সাল ছাড়া), বিভিন্ন দেশে। ইউএনএফসিসিসির মূল দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা বা প্রশমন। এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক দিন ধরে প্রতিবছর কপ-এ, ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তারপর ২০০৭ সালে ১৩তম কপ-এ যুক্ত হয়েছে অভিযোজন, জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রশমনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করার জন্য উন্নত বিশ্ব থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থ প্রদান, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

কিন্তু যখন কপ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে তখন জলবায়ু পরিবর্তনের যে পরিস্থিতি ছিল অর্থাৎ পৃথিবীর উষ্ণায়ন এবং ফলে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ যেমন ছিল, তা থেকে বর্তমান বাস্তবতা অনেক খারাপ।

বাংলাদেশ জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় বছরে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বার্ষিক বাজেট থেকে খরচ করে সাম্প্রতিক সময়ে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের মতো পায়। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনেক গুণ বেশি অর্থের প্রয়োজন, যে পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় নিজেদের সম্পদ এবং যা বাইরে থেকে পাওয়া যায়, তাই দিয়ে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে মানুষকে বাঁচানো এবং তাদের সংকট মোচনের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি অর্থায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির জন্য কপ এবং সংশ্লিষ্ট সব ফোরামে আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রযুক্তি হস্তান্তর, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে পুনর্জাগরণে সহযোগিতা এবং অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা ও দেনদরবার অব্যাহত রাখতে হবে, জোরদার করতে হবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ

Source: https://www.dainikbangla.com.bd/opinion/35064

About the author