লেখকঃ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(০১ অক্টোবর ২২, সমকাল) বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করার আগে বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। বর্তমানে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। আমরা জানি, এর আগেও বিশ্বে বৈষম্য প্রকট ছিল। যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ম্ফীতি বিশ্বের সর্বত্রই ক্রমবর্ধমান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তা এখন ৯-১০ শতাংশ যা দীর্ঘদিনের মধ্যে এমন উচ্চমাত্রার। অন্যান্য উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশেও মূল্যস্ম্ফীতি ইতোমধ্যে অনেক বড়েছে এবং ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশে এখনও তুলনামূলকভাবে মূল্যস্ম্ফীতি খানিকটা কম আছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী তা সাড়ে সাত শতাংশ।
বিশ্বে ব্যাপক মন্দা সৃষ্টি হবে বলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আভাস দেওয়া হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যায় তা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম সুদের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে। একই রকম পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ কমবে, যার ফলে অর্থনৈতিক মন্দাভাব সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ হিসেবে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। এই মন্দাবস্থা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত তো রয়েছেই। মন্দাভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বেশি পড়ে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর। ফলে আগামীতে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিস্তৃতি ও গভীরতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো নিম্ন মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশেকে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটেছে বিগত এক যুগ ধরে। এমনকি করোনকালে পৃথিবীর যে মুষ্টিমেয় দেশ প্রশংসনীয় ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। যদিও বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ সালের ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে অনেক কম তবুও ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ সালে যথাক্রমে ৪ শতাংশ এবং সাড়ে ৬ শতাংশের মতো ছিল। ২০২১-২২ সালে তা আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং আগামী বছরের প্রাক্কলিত হার সাড়ে ৭ শতাংশ। কাজেই লক্ষণীয় যে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। মাথাপিছু বার্ষিক আয়ও ইতোমধ্যে ২,৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছে গেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এই সময়ে খানিকটা কমলেও এখনও ৩৭ বিলিয়নের অধিক আছে। যা যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। এখানে উল্লেখযোগ্য, কিছুটা ধাক্কা খাওয়ার পর রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স প্রাপ্তি উভয়ই আবার ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষণীয়, বাংলাদেশ সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে এবং অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি আশা করি, এসব এবং পরবর্তীতে গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। সে ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনীতিতে তেমন সমস্যার সৃষ্টি হবে না। পাশাপাশি, দেশে খাদ্য এবং অন্যান্য উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সরকার সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং সংশ্নিষ্টরা সচেষ্ট আছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের আগে বাংলাদেশ বর্তমান দশকের শেষ নাগাদ টেকসই উন্নয়ন ও উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য ত্বরান্বিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছিল তখনই করোনা মহামারি এবং পরবর্তীতে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাতে ছন্দপতন ঘটে। তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত (কৃষি এবং অকৃষি বিভিন্ন খাত) করোনাকালের আগে অনেক শক্ত অবস্থানে ছিল এবং অনুকূল সরকারি নীতি এবং সংশ্নিষ্ট সবার (কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা) প্রচেষ্টায় বর্তমানে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশে করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার ও পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য সংকট সৃষ্টি না হওয়ারই কথা এবং একই সঙ্গে দারিদ্র্য নিসরনেও অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়।
তবে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন ও উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে এই দশকের শেষ নাগাদ পৌঁছার পথে কয়েকটি চিহ্নিত সমস্যা সমাধানে আমাদের আরও জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। এগুলোর একটি হচ্ছে- বাজেট ও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও অপচয় পরিহার করে যথাসময়ে কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির কারণে অনেক সম্পদ উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, এমনকি বিদেশেও পাচার করা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকার সচেষ্ট। কিন্তু এ পর্যন্ত অগ্রগতি সামান্যই। যারা এসব অনৈতিক এবং দেশবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।
তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ব্যাপক। শিক্ষিত তরুণরাও উল্লেখযোগ্য হারে বেকারত্বের শিকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের ঘোষিত নীতি হচ্ছে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের সমৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সহায়তা দিচ্ছে। এই কর্মসূচিতে (কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের জন্য দক্ষতা) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু প্রশিক্ষণ দেওয়াই নয় বরং প্রশিক্ষিতদের নূ্যনতম ৭০ শতাংশের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। এই কর্মসূচিতে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সম্পৃক্ত। পিকেএসএফ ইতোমধ্যে তার সহযোগী সংস্থা এবং অন্যান্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৪ হাজার তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং তাদের ৭৩ শতাংশের কর্মসংস্থান (মজুরির বিনিময়ে বা আত্মকর্ম) নিশ্চিত করেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ১২ হাজার তরুণ-তরুণীর জন্য পিকেএসএফ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে এবং আগের মতোই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা হবে।
অবশ্যই অন্যান্য অনেক সংস্থা এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করছে। ফলে এর আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মোট সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এ ছাড়া সরকারের যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থা এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও যুবসমাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও যাতে তারা কাজ পেতে পারে সেভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। তার পরও যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্ব এবং আধা বেকারত্বের ব্যাপক অভিঘাত রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আরও বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। যাতে তারা নিজেদের এবং দেশের উন্নয়নে যথাযথ অবদান রাখতে পারে এবং পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিপথগামী না হয়।
আরও একটি গুরুতর সমস্যা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে, কর্মসূচিও রয়েছে। অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে সম্ভাব্য সক্ষমতার ভিত্তিতে। উল্লেখ্য, ২০২০ রাজস্ব বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকার প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, যা ওই বছরের জাতীয় উৎপাদের ১ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। আসলে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সুতরাং এর সমাধান বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমেই করা যেতে পারে। বর্তমানে অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে। যে কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, তা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ। আর তা অধিক হারে করে আসছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এবং সাম্প্রতিককালে কয়েকটি শিল্পায়নে এগিয়ে চলা বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশ। আন্তঃরাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলের সর্বশেষ (ষষ্ঠ) মূল্যায়নের কর্মদল-১-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুমণ্ডলে পুঞ্জীভূত গ্রিন হাউজ গ্যাস বর্তমানে ২ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীকে প্রথম শিল্পবিপ্লবের আগের তুলনায় যে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উষ্ণ হতে দেওয়া হবে না বলে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেই পরিমাণ উষ্ণায়ন ২০৩০ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে ঘটে যেতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই মূল্যায়নেরই কর্মদল-২-এর প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের ভয়াবহতা যে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে। এ থেকে এটা আবিস্কার, বিশ্ববাসীর সামনে আর মাত্র কয়েক বছর, বড়োজোর বলা যায় ১০ বছর আছে যে সময়ের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দিকনির্দেশনা অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস অনেক বেশি পরিমাণে দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ বিষয়ে খুবই সোচ্চার, অন্য অনেক দেশের সঙ্গে। দাবি হচ্ছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের এবং পরিবেশের দ্রুত অধোগতির জন্য দায়ী, অর্থাৎ বিশ্বের উন্নত এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশ, তারা যেন দ্রুত গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সর্বশেষ বিশ্ব সম্মেলন (কপ-২৬) যা নভেম্বর ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হয় সেখানে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। আগামীতে আলোচনা চলবে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ এবং অন্যান্য ভুক্তভোগী দেশ থেকে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জোর দাবি উত্থাপিত হবে। তবে উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অন্যন্য প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দ নিকট ভবিষ্যতে খুব যে বেশি এগিয়ে আসবেন, সেটা আমার মনে হয় না। আরেকটি দাবি হচ্ছে, ভুক্তভোগী দেশগুলোকে আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান। এ ক্ষেত্রেও উন্নত বিশ্ব থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। এমনকি অঙ্গীকার করেও রক্ষা করা হয় না। কাজেই বাংলাদেশকে নিজস্ব সম্পদ এবং দক্ষতায় যতদূত সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু আমাদের সম্পদ সীমিত, তাই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে অধিক প্রয়োজনীয় অভিযোজন কর্মকাণ্ড গ্রহণ এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ-সংক্রান্ত নীতি ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের দিকনির্দেশনাও রয়েছে। আমি আশা করতে চাই, সে অনুসারে আগামীতে প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। পাশাপাশি অবশ্যই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংশ্নিষ্ট বিষয়গুলোয় সোচ্চার থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর দর্শন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো এবং শেখ হাসিনার অনুরূপ দর্শন দেশে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন। সেই আলোকে আমাদের আগামী পথচলা রচনা করতে হবে। যেহেতু আমরা অর্থনৈতিকভাবে এখন অনেক এগিয়েছি তাই ওই পথ রচনা করার ভিত্তি তৈরি হয়ে আছে বলে আমি মনে করি। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের প্রয়োজন হবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পরার্থপরতা ও দেশপ্রেম যাতে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন মূল্যবোধের অবক্ষয় ব্যাপক, দেশপ্রেমের অভাবও প্রকট। আর পরার্থপরতার কথা আমরা ভুলেই গেছি। অর্থাৎ নিজে এগিয়ে যাব- আর্থিকভাবে, ক্ষমতার দিক থেকে সেটাই হচ্ছে সাধারণভাবে বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে যারা নানাভাবে এগিয়ে আছে তাদের লক্ষ্য। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ খুবই জরুরি এবং উত্তরণের পথ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ই নিহিত রয়েছে। নৈতিকতা, সততা, মানবতা ও মানবিকতার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শনের ভিত্তিতে মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা জরুরি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উল্লিখিত গুণগুলো যাতে ছড়িয়ে পড়ে সেই লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় এবং রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সব অঙ্গনে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রচারাভিযান পরিচালনা করা জরুরি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করতে চাই। কিউকে আহমদ ফাউন্ডেশনের (যেটি আমার ছেলে কাজী রুশদী আহমদ আমার নামে প্রতিষ্ঠা করেছে) অন্যতম প্রধান লক্ষ্য- সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পরার্থপরতা ও দেশপ্রেম তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। এ লক্ষ্যে ফাউন্ডেশন উপজেলাভিত্তিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে আসছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনসহ সবাই এ কার্যক্রমে ফাউন্ডেশনকে সহযোগিতা করছে, উৎসাহিত করছে। অবশ্যই এই ফাউন্ডেশন খুব সীমিত আকারে কাজ করতে পারে। সেজন্য আমাদের সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় এই মানবিক গুণগুলো যাতে সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার ও সংশ্নিষ্ট অন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরেকটি দিক হচ্ছে, ভবিষ্যতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরির পথে আমাদের হাঁটতে হবে। বিশ্বে সে রকমই আগামী গড়ে উঠবে। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ আকাশচুম্বী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি দুশ্চিন্তা আছে, যারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে তারাই কর্তৃত্ব সম্পন্ন হবে এবং বাকি সবাই পিছিয়ে থাকবে। এই সম্ভাব্য পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে জাপানের একটি উদ্যোগ উল্লেখ করতে চাই। এতে প্রযুক্তির ক্রম-অগ্রসরমান বিকাশ সবার উপকারে যাতে আসতে পারে সেটা বিবেচ্য। এই আঙ্গিকে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচেষ্টা চলছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে সোসাইটি-৫। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহারে সবার অংশগ্রহণ যাতে নিশ্চিত হয় সেই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পথপরিক্রমা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে প্রযুক্তি শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহূত হবে না। বরং সবার সামাজিক সমস্যাও একসঙ্গে সমাধান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদিও জাপান একটি উন্নত দেশ। আর বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশ, তবুও আমি মনে করি, সোসাইটি-৫ ধারণা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় আছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অবশ্যই ক্রমান্বয়ে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে সবার আর্থসমাজিক বিকাশে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় এবং সবার, বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা মানুষের বহুমাত্রিক সমস্যা সমন্বিতভাবে সমাধান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এ দেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
Source: